





দশ লিটার খেজুর রস, তাতে দুই কেজি চিনি। রয়েছে সোডা, ফিটকারি, গাছের ছালসহ গুড় তৈরির অন্যান্য উপকরণ। এসবের মিশ্রনে তৈরি করা হচ্ছে গ্রাম বাংলার চিরায়ত ‘খেজুর গুড়’। দশ লিটার রসে এক কেজি চিনির মিশ্রণে গুড় উৎপাদন হচ্ছে চার কেজি। স্বাদ-গন্ধহীন সেই ভেজাল গুড়েই সয়লাব হচ্ছে নাটোরের গুরুদাসপুরের হাট-বাজার।
গুড় বিক্রি করতে আসা আব্দুল আলিম, ইখলাছ, আব্দুল মান্নান ও ফজর আলী জানান, উৎপাদন খরচ বাদে বাড়তি লাভের আশায় খেজুর গুড়ের সাথে চিনি মিশিয়ে উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তারা।






gurudaspur 7-01-22 (1)
চিনিমুক্ত খেজুর গুড়। ছবি: ইত্তেফাক
কিন্তু চাঁচকৈড় বাজার ও নাজিরপুর বাজার এলাকায় অন্ততপক্ষে ১০ জন অসাধু ব্যবসায়ী কারখানা খুলে হাজার হাজার মন ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। তারা বাজার থেকে কমদামে নিম্নমানের ঝোলা ও নরম গুড় কিনে তাতে চিনি, রং, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকারি ও বিশেষ গাছের ছাল গুড়া মিশিয়ে গুড় তৈরি করছেন। সেই গুড় স্থানীয় হাট-বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাক ভরে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
উপজেলার গুড়ের বড় মোকাম চাঁচকৈড় ও নাজিরপুর হাটে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মানভেদে প্রতি কেজি খেজুর গুড় ৯০-১০০ টাকা ও ঝোলাগুড় ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মৌসুমি গুড় উৎপাদনকারিরা এসব গুড় বিক্রি করছেন। গুড় উৎপাদনকারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কার্তিক মাসের মধ্যভাগ থেকে চৈত্রমাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে চলনবিল অঞ্চলের নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, লালপুর, পাবনার চাটমোহর উপজেলায় বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে খেজুর গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে।






gurudaspur 7-01-22 (3)
চিনিযুক্ত ও চিনিমুক্ত আলাদা করে রাখা খেজুর গুড়। ছবি: ইত্তেফাক
উপজেলার চাঁচকৈড় হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা প্রান্তিক গুড় উৎপাদনকারি রব্বেল, মুরশিদ, খবির প্রামানিক ও কোরবান আলী জানান, তারা প্রতিটি গাছের জন্য মালিককে মৌসুম ভিত্তিক (খাজনা) ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা দিয়ে থাকেন। মজুরি, জ্বালানি খরচ বেশি হওয়ায় গুড়ের উৎপাদন খরচই ওঠে না। খাঁটি গুড়ের উৎপাদন খরচ পড়ে গড়ে ১৫০ টাকা। কিন্তু বাজারে এত দামে বিক্রি করা যায় না। তাই গুড়ের চাহিদা ও উৎপাদন খরচ পুষিয়ে নিতে প্রতি ১০ লিটার রসে দুই কেজি চিনি মেশান তারা। গুড়ের রং ফর্সা ও শক্ত করতে চিনি মেশাতে বাধ্য হন তারা। চিনি মেশানো এই গুড়ে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ থাকে না। পিঠা-পায়েসে গুড়ের উপযোগীতাও থাকে না। তবে চিনিমুক্ত গুড়ের রং হয় কালো। তাতে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ অটুট থাকে। এই গুড় প্রতিকেজি ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।






এসব গুড় উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাদের ভাষ্যমতে, প্রতি ১০ লিটার খেজুর রসে ১কেজি গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতি কেজি গুড় উৎপাদনে জ্বালানি ও মজুরিসহ খরচ হয় ৭০ টাকা। পক্ষান্তরে ১০ লিটার রসের সাথে ২ কেজি চিনি মেশালে গুড় বেড়ে হয় দ্বিগুন। প্রতিকেজি গুড়ের দাবি গড়ে ১০০ টাকা হলে ৫ কেজি গুড়ের ৫০০ টাকা হয়। সেক্ষেত্রে ২ কেজি চিনিতে চার কেজিরও বেশি গুড় উৎপাদন হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ৮০ টাকা। ভেজাল গুড় তৈরি করে বাড়তি মুনাফা আসছে।
gurudaspur 7-01-22 (2)
খেজুর গুড়। ছবি: ইত্তেফাক
ঢাকা থেকে আসা পাইকার আকবর আলী ও সিরাজগঞ্জের উল্লাহপাড়া থেকে আসা ইলিয়াস ব্যাপারী জানান, খেজুর গুড়ের সেই ঐতিহ্য আর নেই। প্রান্তিক পর্যায়ের মৌসুমি গুড় উৎপাদনকারি ও মহাজন সকলেই ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। গুড়ের রং ফর্সা ও শক্ত করতে তারা যথেচ্ছভাবে চিনির সাথে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন।
খেজুর গাছ নিধনের কারণ হিসাবে স্থানীয়রা বলছেন, গত প্রায় দেড় দশক ধরে যথেচ্ছাভাবে খেজুর গাছ কেটে ইটভাটার জ্বালানির চাহিদা মেটানো, আবাদী জমি কেটে পুকুর খনন, আম-লিচুর বাগান তৈরি করায় খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে। নিধনকৃত গাছের অভাব পূরণে নতুন করে গাছ লাগানো হচ্ছে না। আবার যেসব গাছ রয়েছে সেসব গাছ সংরক্ষণের কোন উদ্যোগও নেই।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুনর রশিদ জানান, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ৬৮হাজার ৮৯০টি খেজুর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে রস দেওয়ার উপযোগী গাছের সংখ্যা রয়েছে ৪১ হাজার ৮১০টি। পরিসংখ্যানমতে, প্রতিটি গাছ বছরের শীত মৌসুমে ১৮০ লিটার রস দেয়। প্রতি ১০ লিটারে ১ কেজি গুড় হয়। ওই হিসাবে ৭২০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন হয়। বাজারে প্রতি কেজি গুড়ের উৎপাদক পর্যায়ে ৮০ টাকা কেজি দরে আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ছয় কোটি টাকার ওপরে। তবে ইটভাটার কারনে খেজুর গাছের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মুজাহিদুল ইসলাম জানান খেজুর গুড়ে চিনি, রং, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকারিমত ভেজাল মিশ্রণের কারনে খাদ্যনালীরতে ক্যান্সার, কিডনী ড্যামেজ, লিভারে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. তমাল হোসেন জানান, এই অঞ্চলের খেজুর গুড়ের সুনাম রয়েছে। ভেজাল গুড়ে ভেজাল মেশানোর বিচ্ছিন্ন অভিযোগ তার কাছে রয়েছে। দ্রুত অভিযানে নামবেন তিনি।